শেখ হাসিনাকে ঘিরে বদলে যাচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক বার্তা
শেখ হাসিনাকে ঘিরে বদলে যাচ্ছে ভারতের রাজনৈতিক বার্তা
ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনাকে ঘিরে ভিন্ন ধরনের বার্তা ও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আগে যেভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল, এখন সেখানে এসেছে দ্বিধা, সমালোচনা ও কৌশলগত দূরত্ব।
শেখ হাসিনা, ভারতের রাজনৈতিক বার্তা, ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক, মোদি সরকার, আন্তর্জাতিক কূটনীতি
শেখ হাসিনা, ভারত, বাংলাদেশ নির্বাচন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ভারতীয় মিডিয়া, মোদি, বিজেপি, কূটনৈতিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দক্ষিণ এশিয়া
গত এক দশকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তা নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের মিডিয়া ও রাজনৈতিক পরিসরে শেখ হাসিনা বিষয়ে যে বার্তাগুলো শোনা যাচ্ছে, তাতে কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
ভারতের শাসক দল বিজেপি, বিরোধী দল কংগ্রেস ও মিডিয়াতে এখন এমন কিছু ভাষা ও বক্তব্য দেখা যাচ্ছে, যা অতীতে খুব একটা চোখে পড়েনি। প্রশ্ন উঠছে—ভারতের রাজনৈতিক বার্তা কি সত্যিই বদলে যাচ্ছে শেখ হাসিনাকে ঘিরে? না কি এটি শুধুই নির্বাচনের আগে কৌশলগত অবস্থান?
ভারতের প্রভাবশালী টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাগুলোর রিপোর্টিং ট্রেন্ডে এক ধরনের নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যেখানে আগে শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল মিডিয়া, এখন তারা বলছে—
“বাংলাদেশে একদলীয় শাসন চলছে!”
“মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে বিরোধী দল!”
“নির্বাচন কি আদৌ অংশগ্রহণমূলক হবে?”
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শিরোনাম:
“Democracy in Bangladesh at stake” – India Today
“Bangladesh elections raise international concern” – NDTV
“Sheikh Hasina losing grip over public perception?” – Times Now
এই ধরনের শিরোনামগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারতের মিডিয়া, এবং হয়তো রাষ্ট্রের ভেতরের নীতিনির্ধারকরাও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবছেন।
মোদি সরকারের বার্তায় পরিবর্তন?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার অতীতে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি একরকম অন্ধ সমর্থনই দিয়ে এসেছে। ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ভারত খুব দ্রুত নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছিল এবং সরকার গঠনের পরপরই অভিনন্দন জানিয়েছিল।
কিন্তু ২০২৩-২৫ পর্বে এসে সেই সমর্থনের ভাষা খানিকটা ঠাণ্ডা। সরকারিভাবে এখনো স্পষ্ট সমালোচনা করা না হলেও দেখা যাচ্ছে—
আরও পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর প্রতিনিধিদের দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার রাজনৈতিক মহলে শেখ হাসিনার সমালোচনা বাড়ছে।
পশ্চিমা দুনিয়ার মতো ভারতও এখন ‘বৈধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ নিয়ে জোর দিচ্ছে।
কূটনৈতিক স্তরেও ঠান্ডা বার্তা:
২০২৫ সালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা কামনা করি।”
এমন বিবৃতি আগে খুব একটা শোনা যায়নি।
কেন এই বার্তার পরিবর্তন?
১. পশ্চিমা প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারকে চাপ দিতে তারা ভিসা নীতিও গ্রহণ করেছে। ভারত তাদের সঙ্গে কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ—তাই হয়তো এখন সরাসরি সমর্থন নয়, বরং ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ অবস্থানে থাকতে চাইছে।
২. আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রের চাপ
ভারত নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুলে ধরে। সেই অবস্থান থেকে দেখা যাচ্ছে—একদলীয় শাসন এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন ভারতের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৩. বিকল্প নেতৃত্বের প্রস্তুতি?
শোনা যাচ্ছে, ভারতের রাজনৈতিক মহল হয়তো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবছে। সেখানে শেখ হাসিনার বিকল্প খোঁজার কৌশলও থাকতে পারে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগযোগ্য কোনো নেতাকে সামনে আনতে চাইছে তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত
বিশিষ্ট ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক রামচন্দ্র গুহা এক সাক্ষাৎকারে বলেন—
“বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। শেখ হাসিনা অনেক কিছু করেছেন, তবে দীর্ঘদিন ধরে একই নেতৃত্ব চললে সমস্যা হয়। এটা ভারত জানে।”
বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন,
“ভারত সবসময় বাস্তববাদী। যেখান থেকে বেশি লাভ, সেদিকে যাবে। এখন তারা হয়তো মনে করছে, শেখ হাসিনার সময়ে কিছু ইস্যুতে সমস্যায় পড়ছে—তাই অবস্থান বদলে দিচ্ছে।”
মিডিয়ার ভাষা বদলানোর ইঙ্গিত কি রাজনীতির ভবিষ্যৎ?
একটি দেশের মিডিয়া যখন নেতিবাচক বার্তা দিতে শুরু করে, সেটা সাধারণত সরকার বা শাসক দলের ‘রোডম্যাপ পরিবর্তনের ইঙ্গিত’ হিসেবে ধরা হয়। ভারতের মিডিয়াগুলোর স্বর এই মুহূর্তে অনেকটাই কৌশলী:
আগে সরাসরি প্রশংসা করত, এখন তুলনামূলকভাবে 'ব্যালান্সড' রিপোর্ট করছে।
বিরোধীদের বক্তব্য প্রচার করছে বেশি।
আন্তর্জাতিক চাপে ভারতও চাইছে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিতে।
ভারতীয় টক শোগুলোর রূপান্তর
ভারতের টিভি টক শোগুলোতেও এখন বাংলাদেশের বিষয়টা প্রায় নিয়মিত আলোচনার অংশ হয়ে উঠেছে। সেখানে বাংলাদেশি সাংবাদিক, গবেষক, এমনকি বিরোধী নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
একটি শো-তে ভারতীয় অ্যাঙ্কর বলেছিলেন
“বাংলাদেশে যে একচ্ছত্র ক্ষমতা চলছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।”
জনগণের প্রতিক্রিয়াও বদলাচ্ছে?
ভারতের সাধারণ জনগণের মধ্যেও এখন শেখ হাসিনা সম্পর্কে আগের মতো আগ্রহ বা সহানুভূতি নেই বলেই মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক।
বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ এখন বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন বাংলাদেশে পরিবর্তন কেমন হবে তা নিয়ে।
ভারতের রাজনৈতিক বার্তা শেখ হাসিনাকে ঘিরে বদলে যাচ্ছে—এটা এখন আর গুজব নয়, বাস্তব। মিডিয়ার ভাষা, সরকারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বার্তা, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত—সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, দিল্লি এখন খুব হিসেব করে পা ফেলছে।
তবে এ পরিবর্তন একেবারে সমর্থন প্রত্যাহার নয়, বরং একধরনের ‘কৌশলগত দূরত্ব’—যা প্রয়োজনে আবার ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিতে পারে, কিংবা আরও বিচ্ছিন্নতাও তৈরি করতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার এই বার্তা থেকে কী ইঙ্গিত নেয়, এবং তার কৌশলে কী পরিবর্তন আসে?