শেখ হাসিনার প্রতি আচরণ বদলাচ্ছে ভারতের মিডিয়া
শেখ হাসিনার প্রতি আচরণ বদলাচ্ছে ভারতের মিডিয়া
মিডিয়ায় শেখ হাসিনার উত্থান: একটা সময় ছিল যখন… ২০০৯
সালে আওয়ামী লীগ:সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় মিডিয়ায় শেখ হাসিনার প্রতি সহানুভূতির সুর চোখে পড়ত। বিশেষ করে ভারতের নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ নীতিতে ‘বঙ্গবন্ধু কন্যার’ দৃঢ় অবস্থান প্রশংসিত হতো। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের কড়া অবস্থান ভারতের মিডিয়ায় ব্যাপক কভারেজ পেত। NDTV, The Hindu, Times of India, The Indian Express - এ সকল মাধ্যমগুলোতে তাঁকে 'India’s most reliable ally in South Asia' বলা হত। পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়াগুলো যেমন আনন্দবাজার, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন — তাঁকে প্রায় 'বাংলার মেয়ে'র মর্যাদায় দেখত।
ভাষার ভিন্নতা:
এখন সমালোচনার ঝড় ২০২৪
সাল থেকে ধীরে ধীরে এই চিত্র বদলাতে
থাকে। ২০২৫ সালের মধ্যভাগে এসে ভারতের মিডিয়ায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে আগের সেই সুর আর পাওয়া যাচ্ছে
না। বরং দেখা যাচ্ছে— •
আরও পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“শেখ হাসিনার অধীনে গণতন্ত্র হুমকিতে” (Times Now) • “বাংলাদেশে বিরোধী কণ্ঠ দমন” (The Print) • “Bangladesh's iron lady turning into authoritarian?”
(India Today) শুধু শিরোনাম নয়,
ভেতরের উপস্থাপনাও কড়া। এখন তাঁর সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, সাংবাদিক নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়ে সরব হয়ে উঠেছে ভারতের মিডিয়া।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় নজরদারি বেড়েছে: ২০২৫
২০২৫সালের শেষভাগে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন। এরই মধ্যে বিরোধী দল বিএনপি এবংঅন্যান্য গোষ্ঠীগুলো আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক লবিং শুরু করেছে। এ অবস্থায় ভারতেরমিডিয়াও আগ্রহী হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। আগে ভারত সরকার বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চেয়েছে, কিন্তু এখন ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাদের মিডিয়ায় সরব ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। এর একটি বড় উদাহরণ NDTV-র
একটি বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যেখানে বলা হয় বাংলাদেশে
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, ভারত কি দূরত্ব বাড়াবে?”
মোদি বনাম হাসিনা: সম্পর্ক কি ঠাণ্ডা? শুধু মিডিয়া নয়, কূটনৈতিকভাবেও ভারতে এখন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছে। বিজেপি সরকার, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদি ও
অমিত শাহের নেতৃত্বে, বাংলাদেশ বিষয়ে যে আগ্রহ ছিল, তা কিছুটা কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বর্তমান সরকার নিজেদের 'ভারতপ্রথম' নীতির কারণে আর আগের মতো কৌশলগত বন্ধুত্বে আবদ্ধ থাকতে আগ্রহী নয়। ফলে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছে, তার মূল্যায়ন কমে গেছে। মিডিয়াও এরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ
বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার) প্রভৃতি মাধ্যমে ‘প্রবাসী’ ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের তৈরি কনটেন্ট ভারতের মূলধারার মিডিয়াকে প্রভাবিত করছে। বহু ইউটিউব চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার এখন শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে তথ্যচিত্র, বিশ্লেষণ ও বিতর্কমূলক ভিডিও তৈরি করছে—যা কয়েক মিলিয়ন বার দেখা হচ্ছে। ভারতের মিডিয়াগুলো এসব ভিডিও ও বিশ্লেষণকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশি বিরোধী দলের ‘প্রক্সি’ কি ভারতের মিডিয়া?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতীয় মিডিয়ায় এই হঠাৎ পরিবর্তনের পেছনে ‘চরিত্র বদল’ রয়েছে। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল যারা আন্তর্জাতিক কৌশলে ভারতকে একসময় বাদ দিয়ে পশ্চিমা দিকেই ঝুঁকেছিল, তারা এখন আবার
ভারতের দরজায় কড়া নাড়ছে। মিডিয়ার ওপর প্রভাব রয়েছে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক লবির। ভারতের বিরোধী রাজনীতিকরাও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাইলে মিডিয়া সেই ভাষা ধারণ করে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতমুখী অভিবাসনের আশঙ্কা
ভারতের মিডিয়ায় একটি বড় ইস্যু হিসেবে উঠে আসছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট এবং এর প্রভাবে ভারতমুখী অভিবাসন প্রবাহের সম্ভাবনা। “Bangladesh’s collapsing economy could fuel illegal migration into India” — টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এমন প্রতিবেদনে সরাসরি অভিযোগ তোলা হয়েছে। এভাবে মিডিয়ায় শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে এবং ভারতীয় জনমতও দূরত্বে যাচ্ছে।
তিস্তা, সীমান্ত, বিচ্ছিন্নতা—নতুন করে আসছে পুরনো ইস্যু
অনেকদিন পর ভারতের মিডিয়ায় আবারও তিস্তা চুক্তি, সীমান্তে বাংলাদেশিদের মৃত্যু, এমনকি পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে। NDTV, Zee News এমনকি Bengali Times Now-ও এ বিষয়ে নিয়মিত কভারেজ দিচ্ছে। এমনকি ভারতে BJP-এর কিছু নেতা সংবাদমাধ্যমে বলছেন: “বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নেই, শেখ হাসিনার আমলেও হামলা থামেনি” — এমন বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকার কীভাবে দেখছে এই পরিবর্তন?
বাংলাদেশ সরকার আপাতদৃষ্টিতে এ
বিষয়ে মুখে কিছু না বললেও, অভ্যন্তরীণভাবে ভারতের মিডিয়া আচরণের পরিবর্তনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে পররাষ্ট্র দপ্তরের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ‘অপ্রতিরোধ্য’ বললেও এই পরিবর্তনকে হালকাভাবে দেখছে না ঢাকা। তবে ভারত সফরে গেলে শেখ হাসিনার প্রতি এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু মিডিয়ার এই বদলে যাওয়া সুর রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।
মিডিয়ার ভিন্ন সুর: হুঁশিয়ারি না বার্তা?
ভারতের মিডিয়ার এই অবস্থান কিছু বিশেষজ্ঞের মতে একটি “কূটনৈতিক বার্তা”। তারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার সরকার যেন জনগণের অধিকার, রাজনৈতিক বিরোধীদের সুযোগ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তা-ই চায় ভারত। আর তাই মিডিয়ার মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে বার্তা—“নির্বাচন সঠিক না হলে সমর্থন থাকবে না।”
উপসংহার: একটি গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল
ভারতের মিডিয়ার শেখ হাসিনা-সংক্রান্ত ভাষা ও আচরণ যে বদলেছে, তা এখন স্পষ্ট। এটা শুধুই সাংবাদিকতার ভাষাগত পরিবর্তন নয়—এটি এক ধরনের কৌশলগত পুনর্বিন্যাস। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ইঙ্গিত। বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নির্বাচনের গতিপথ অনেকটাই নির্ধারণ করতে পারে ভারতের এই মিডিয়া সুর। তাই এখনই সময় শেখ হাসিনার সরকারকে গভীরভাবে এই বার্তাটি বুঝে, তার কূটনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক
নীতিগুলো পুনর্বিন্যাস করা। সারসংক্ষেপ (Summary in Bullet Points):
•একসময় ভারতীয় মিডিয়ায় শেখ হাসিনার প্রশংসা ছিল অতুলনীয়।
• এখন মিডিয়ার সুর পাল্টে হয়ে গেছে কড়া সমালোচনামূলক।
• গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন—এখন মূল আলোচ্য বিষয়।
•পশ্চিমা লবির পাশাপাশি ভারতীয় মিডিয়াও এখন ‘নিরপেক্ষ’ হতে চাইছে।
• ভারতীয় মিডিয়ার এই রূপান্তর এক কৌশলগত বার্তা।