ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড প্রধান হোসেইন সালামি নিহত, তেহরানে উত্তেজনা
তেহরান, ১৩ জুন ২০২৫ — মধ্যপ্রাচ্য যেন আরেকবার আগুনে জ্বলে উঠল। ইসরায়েলের চালানো এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের (IRGC) প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে তেহরান কর্তৃপক্ষ। এই হামলা ঘটেছে সিরিয়ার দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে, যেখানে ইরানি সামরিক উপদেষ্টারা নিয়মিত সমন্বয় মিশনে থাকতেন।
এ ঘটনা ঘিরে ইরানজুড়ে গভীর শোক এবং তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তেহরানের রাস্তায় ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেয়ী এই ঘটনাকে ‘জাতীয় শোক ও প্রতিরোধের আহ্বান’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
ঘটনার বিস্তারিত: সিরিয়ায় গোপন ঘাঁটিতে হামলা
বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যম অনুসারে, হামলাটি হয় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি সামরিক কমপ্লেক্সে। মঙ্গলবার রাত ২:৪৫ মিনিটে ইসরায়েলের জঙ্গি বিমান থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় ছয়টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি কমপ্লেক্সের মূল ভবনে আঘাত হানে, যেখানে ইরানি সেনা উপদেষ্টা এবং কমান্ড ইউনিট অবস্থান করছিল।
হামলার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, যিনি ২০১৯ সাল থেকে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একইসঙ্গে আরও অন্তত ১১ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে সিরিয়ার মানবাধিকার সংস্থা।
ইসরায়েলের অবস্থান: নীরবতা বজায়
ইসরায়েল এখনও এই হামলার দায় স্বীকার করেনি, তবে পূর্বের সামরিক নীতিমালার আলোকে অনুমান করা যায় যে, তারা সরাসরি জবাব না দিলেও হামলাটি তাদেরই পরিকল্পিত। গত কয়েক বছর ধরেই ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি কমানোর জন্য একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে আসছে।
তবে এবার যেহেতু নিহত হয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ সামরিক কমান্ডারদের একজন, এটি স্বাভাবিক হামলা নয় — বরং একে বিশ্লেষকরা ‘যুদ্ধের সূচনা’ বলেও আখ্যায়িত করছেন।
ইরানের প্রতিক্রিয়া: প্রতিশোধের অঙ্গীকার
তেহরানে এই ঘটনার পরপরই জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সর্বোচ্চ নেতা খামেনেয়ী সেনাবাহিনীর সকল শাখাকে ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ থাকার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে একটি ঘোষণায় বলা হয়:
“আমাদের প্রধান সেনাপতির রক্ত বৃথা যাবে না। আমরা প্রতিটি বিন্দুর জন্য প্রতিশোধ নেব। ইসরায়েলকে এখন মূল্য চুকাতে হবে।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে জরুরি বৈঠকের অনুরোধ করেছেন এবং ইসরায়েলকে ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
তেহরানে উত্তেজনা ও জনরোষ
হোসেইন সালামির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই তেহরান শহর জুড়ে ব্যাপক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ কালো পতাকা হাতে শহরের কেন্দ্রীয় রাস্তাগুলোতে জড়ো হয়। বহু যুবক ও ছাত্রছাত্রীরা মার্কিন ও ইসরায়েলি পতাকা পুড়িয়ে প্রতীকী প্রতিবাদে অংশ নেয়।
তেহরানের আজাদি স্কয়ারে এক সমাবেশে অংশ নিয়ে এক বিক্ষোভকারী বলেন:
“আমরা যুদ্ধ চাই না, তবে অপমানিত হয়ে বাঁচতেও চাই না। সালামির মৃত্যুর পর আর বসে থাকা সম্ভব নয়।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার পরপরই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়া এবং চীন উভয়েই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সিরিয়া ও ইরানকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক বিবৃতিতে বলেন:
“এই ধরণের আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল এবং একে আমরা চুপচাপ মেনে নেব না।”
চীন বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ইসরায়েলি প্ররোচনায় যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে, তা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলেও প্রতিক্রিয়া ফেলবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র হোয়াইট হাউজ থেকে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বলেছে, “ঘটনার বিষয়ে আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ইরান ও ইসরায়েল উভয়পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানাই।”
হোসেইন সালামি: একটি জীবন্ত প্রতীক
হোসেইন সালামি ছিলেন ইরানের এক প্রতীকী চরিত্র। ২০১৯ সালে কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর তিনিই হন ইরানের প্রধান কৌশলবিদ। বিশেষ করে হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী এবং হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের সামরিক উপস্থিতি দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তাঁর সামরিক কৌশল নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো সবসময়ই শঙ্কিত ছিল। অনেক বিশ্লেষক বলেন, ইরানের আঞ্চলিক প্রতিরোধ গঠনের মূল কাণ্ডারি ছিলেন সালামি।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও রাষ্ট্রীয় শোক
তেহরানে পাঁচদিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। আজকের মধ্যেই তার মরদেহ দামেস্ক থেকে তেহরান আনা হবে এবং তেহরানের বিখ্যাত ইমাম খোমেনি মসজিদ প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।
ইরানি সরকার এই দাফনকে ‘জাতীয় প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছে এবং দেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পরবর্তী সম্ভাব্য পরিস্থিতি: যুদ্ধ নাকি কূটনীতি?
এই ঘটনার পর পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নির্ভর করছে ইরান ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে:
সরাসরি সামরিক প্রতিশোধ: ইরান সরাসরি ইসরায়েলি স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে, বিশেষ করে গোলান মালভূমি বা লেবাননের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে।
প্রক্সি যুদ্ধ: ইরান তার মিত্র গোষ্ঠীগুলোর (হিজবুল্লাহ, হামাস, হুথি) মাধ্যমে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে পারে।
কূটনৈতিক চাপ: ইরান আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (OIC) মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হামিদ মোসাভি বলেন:
“এই হামলা কেবল একজন সামরিক নেতার মৃত্যু নয়, বরং ইরানের জাতীয় মর্যাদার উপর আঘাত। এর প্রতিক্রিয়া নির্ভর করছে খামেনেয়ীর সিদ্ধান্তের ওপর, তবে ইরান এবার চুপচাপ বসে থাকবে না।”
আরেক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. লিয়াম স্টোন মন্তব্য করেন:
“ইসরায়েল যদি সত্যিই এই হামলার পেছনে থাকে, তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।”