Banner 728x90


পাল্টা আক্রমণ শুরু ইরানের; প্রায় ১০০ ড্রোন পাঠিয়েছে ইসরায়েলে ,

  


      তেহরান-জেরুজালেম: মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার আগুন জ্বলছে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাবে এবার সরাসরি আক্রমণে নেমেছে ইরান। তেহরান সরকার শনিবার গভীর রাতে ইসরায়েলের দিকে প্রায় ১০০টিরও বেশি ড্রোন পাঠিয়েছে, যা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চরমভাবে সতর্ক করেছে। এই পদক্ষেপকে বিশ্লেষকেরা বলছেন—‘মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতির আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া’।

ইরানের পাল্টা জবাব: এক নজরে

ইরান জানায়, এটি একটি "প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ", যার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনা। ড্রোনগুলোর বেশিরভাগই ছিল 'শাহেদ' সিরিজের আত্মঘাতী ড্রোন, যেগুলোর বহুল ব্যবহার ইতিপূর্বে ইউক্রেন যুদ্ধেও দেখা গেছে। এই ড্রোনগুলো একই সঙ্গে দূরপাল্লার এবং ক্ষেপণশক্তিতে অদ্বিতীয়।

তেহরানের সামরিক সূত্রগুলো জানায়, ড্রোন আক্রমণের সময় গণমাধ্যমে blackout ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক কমান্ডাররা নিজ নিজ দায়িত্বে সক্রিয় ছিলেন। জানা গেছে, এই ড্রোনগুলোর গন্তব্য ছিল ইসরায়েলের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া: চরম সতর্কতা ও পাল্টা প্রস্তুতি

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) জানায়, তারা প্রথম পর্যায়ে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ এবং ‘ডেভিড’স স্লিং’ সক্রিয় করে এবং বেশ কিছু ড্রোন মাঝ আকাশেই গুলি করে ধ্বংস করা হয়েছে। তবে কিছু ড্রোন ইসরায়েলের ভূখণ্ডে পৌঁছেছে এবং ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক জরুরি বিবৃতিতে বলেন:

“ইরানের এই আক্রমণ আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত। আমরা নিরুত্তাপ থাকবো না। আমাদের সামরিক বাহিনী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত।”

আগুনে ঘি ঢালার ইতিহাস: পেছনের প্রেক্ষাপট

এই পাল্টা আক্রমণের মূলে রয়েছে ইসরায়েলের একটি বিস্ফোরক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, যেখানে নিহত হয়েছিলেন ইরানের বিপ্লবী গার্ডের উচ্চপদস্থ কমান্ডার। সিরিয়ায় একটি ইরানি কনস্যুলেট ভবনে পরিচালিত সেই হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে চারজন ছিলেন ইরানি বিপ্লবী গার্ডের সদস্য।

এই হামলার পর ইরান রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেয়, "উত্তর দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে তারা"। ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় এলো এই ড্রোন আক্রমণ।

আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া: সন্ত্রস্ত আরব বিশ্ব, সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্র

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় গোটা আরব বিশ্ব চরম উদ্বেগে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার নিজেদের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। বাহরাইন ও ওমান সতর্ক বার্তা জারি করেছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পেন্টাগন জানায়, তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ‘সেন্টকম’ বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানবাহী রণতরী ইতোমধ্যেই পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পৌঁছেছে।

ইসরায়েলের ভিতরে জনমত: আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা ও প্রস্তুতি

ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানী জেরুজালেম, তেল আবিব, হাইফা সহ বিভিন্ন শহরে বোমা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইসরায়েলি সেনা বাহিনী রিজার্ভ সেনাদের তলব করেছে।

একজন তেল আবিব বাসিন্দা বলেন:

“রাতে আমরা ঘুমাতে পারি না। সাইরেন বেজে উঠছে, আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হচ্ছে। এটা যুদ্ধের মতো অবস্থা।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘের উদ্বেগ, চীনের উদ্বেগ, ভারতের ভারসাম্যপূর্ণ বার্তা

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তার প্রভাব হবে বৈশ্বিক। আমরা সংযম ও শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করছি।”

চীন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে।”

ভারত এক বিবৃতিতে উভয় পক্ষকে সংযত থাকতে আহ্বান জানিয়েছে এবং অঞ্চলটিতে নিযুক্ত ভারতীয় নাগরিকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে: 'পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের শুরু?'

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবলমাত্র একটি পাল্টা জবাব নয়—বরং এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন সামরিক সংঘাতের সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন:

“ইরান এতদিন সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক হামলায় অংশ নিত না। এবার প্রথমবারের মতো তারা নিজেদের নামেই আক্রমণ চালালো, যা এই অঞ্চলের কৌশলগত মানচিত্র পাল্টে দিতে পারে।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

বর্তমানে যুদ্ধ পরিস্থিতি যতদূর গড়িয়েছে, তাতে করে তিনটি সম্ভাব্য চিত্র বিশ্লেষকরা তুলে ধরছেন—

  1. সীমিত পাল্টা যুদ্ধ: ইসরায়েল সীমিত পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে পারে।

  2. সম্পূর্ণ যুদ্ধ: উভয় পক্ষই চূড়ান্ত সামরিক পথে এগিয়ে গেলে তা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে।

  3. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সাময়িক স্থিতি: জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া মধ্যস্থতায় এগিয়ে এলে যুদ্ধ সাময়িক স্থগিত হতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: তেলের দামে লাফ, স্টক মার্কেট অস্থির

এই উত্তেজনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭ ডলার বেড়ে গেছে। বিশ্বের বড় বড় স্টক মার্কেটে ধস নেমেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ব্যাপক পতন ঘটেছে।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই জ্বালানির সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ইসলামী বিশ্বে প্রতিক্রিয়া: 'ইসরায়েলকে উচিত শিক্ষা'

হিজবুল্লাহ, হামাস সহ অন্যান্য ইরানঘনিষ্ঠ সংগঠন এই হামলার প্রশংসা করেছে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আনন্দ মিছিল করেছে হাজারো মানুষ।

তবে সৌদি আরব এখনো পর্যন্ত কোনো সরাসরি মন্তব্য করেনি।

সাধারণ মানুষের মুখে মুখে যুদ্ধের ছায়া

মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনা এখন কেবল কূটনৈতিক সীমায় নেই। এটি ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে, মনে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে।

দুবাইয়ে বসবাসরত এক বাংলাদেশি প্রবাসী বলেন:

“আমরা রাতে বাসা থেকে বের হই না। পেট্রোল পাম্পে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটা আর শুধু ইরান-ইসরায়েলের ব্যাপার নয়, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রভাব ফেলছে।”


উপসংহার

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। এই সংঘাত যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়—গোটা বিশ্বকে এর মূল্য চুকাতে হতে পারে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া বিকল্প নেই।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url