ভিকারুননিসার ছাত্রীকে সাঁতার শেখাতে গিয়ে ডুবে গেলেন বাবা-মেয়ে দুজনেই
ঢাকা, জুন ১১:
এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হলো রাজধানী ঢাকা। পরিবারের এক অনুশীলন ঘিরে আনন্দময় সময় কাটানোর পরিকল্পনা পরিণত হলো চিরবিচ্ছেদের বেদনায়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম ও তার বাবা শফিকুল ইসলাম রাজধানীর উত্তরার একটি সুইমিং পুলে সাঁতার শেখার সময় পানিতে ডুবে মারা গেছেন। শনিবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে, যা শোকের ছায়া ফেলেছে পুরো এলাকায় ও শিক্ষাঙ্গনে।
ঘটনা যেভাবে ঘটেছে
প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, সাদিয়ার বাবা শফিকুল ইসলাম নিজে সাঁতার জানতেন এবং মেয়েকে নিজ হাতে শেখানোর ইচ্ছা ছিল তার অনেক দিনের। পড়াশোনার ফাঁকে মেয়েকে খেলাধুলার পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল করে তোলার ইচ্ছা থেকেই তিনি নিয়মিত মেয়েকে নিয়ে যেতেন উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের একটি প্রাইভেট সুইমিং ক্লাবে।
শনিবার বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে শফিকুল ইসলাম ও তার মেয়ে সাদিয়া পুলে নামেন। প্রাথমিকভাবে সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সাদিয়া গভীর পানির অংশে চলে গেলে হঠাৎই পানিতে হাবুডুবু খেতে শুরু করে। বাবা শফিকুল দ্রুত মেয়েকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেন, কিন্তু অদৃশ্য এক বিভ্রান্তি, হয়তো পানির নিচে ঝড় সৃষ্টিকারী সিস্টেম বা হঠাৎ পুলের গভীরতায় ভারসাম্য হারানো—তাদের দুজনকেই আর জীবিত তুলে আনা সম্ভব হয়নি।
উদ্ধার ও চিকিৎসা
ক্লাবের নিরাপত্তাকর্মী ও উপস্থিত কয়েকজন তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। আনুমানিক ১০ মিনিটের মধ্যে দুজনকেই পানির নিচ থেকে তোলা হয় এবং দ্রুত উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা তখনই দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. রাকিব হাসান জানান, দুজনেই হাসপাতালে আনার আগেই মারা গেছেন। শরীরে তাজা অক্সিজেনের ঘাটতির লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। প্রায় ৮-১০ মিনিট পানির নিচে ছিলেন তারা।
ভিকারুননিসা স্কুলে শোকের ছায়া
সাদিয়ার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজে শোকের ছায়া নেমে আসে। সহপাঠীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট করে, কেউ কেউ ভিডিও বানিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফারহানা ইসলাম বলেন,
“সাদিয়া মেধাবী, হাসিখুশি ও ভদ্র একটি মেয়ে ছিল। তার অকাল মৃত্যুতে আমরা সবাই মর্মাহত। পুরো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকমহল এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এই খবর দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন একটি প্রাইভেট সুইমিং ক্লাবে পর্যাপ্ত লাইফগার্ড থাকবে না? ক্লাব কর্তৃপক্ষ কি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল?
সুশীল সমাজের কেউ কেউ এই ঘটনাকে একটি “মানবিক ব্যর্থতা” হিসেবে দেখছেন। শিশুদের নিরাপত্তা এবং জনসাধারণের জিম ও সুইমিং ক্লাবগুলোর যথাযথ লাইসেন্সিং ও নিয়ম মানার প্রশ্নটিও সামনে এসেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন অভিভাবক লেখেন:
“আমি নিজেও সন্তানকে সুইমিং শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজকের এই ঘটনা আমাকে শঙ্কিত করে তুলেছে। ক্লাবে কি কেউ দেখে না? কার দায়িত্বে নিরাপত্তা?”
ক্লাব কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
ঘটনার পর ক্লাব কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের জানান,
“ঘটনার সময় একজন ইনস্ট্রাক্টর পুলে ছিলেন না, কারণ এটি ‘প্রাইভেট সেশনে’ ছিল। ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী, যেসব সদস্য সাঁতার জানেন, তারা নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এ ঘটনায় আমরা দুঃখিত। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
তবে এই বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, এমন নিয়ম শিশুদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
মায়ের কান্না—এক অনন্ত ব্যথার গল্প
সাদিয়ার মা নিশাত ইসলাম সাংবাদিকদের চোখের জলে বলেন,
“ওর বাবা কত ভালোবাসতো মেয়েটাকে! নিজ হাতে সাঁতার শেখাতে নিয়ে গেলো। এখন দুজনেই নেই। আমার ঘর একেবারে শূন্য হয়ে গেলো। আমি কার জন্য বাঁচবো এখন?”
তার কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে হাসপাতালের বাতাস। আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি শুধু বলেন,
“বাচ্চা মেয়েটা কত স্বপ্ন দেখতো, ডাক্তার হবে বলতো। আমার সব শেষ হয়ে গেলো।”
প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া
শফিকুল ইসলামের পরিবার উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। প্রতিবেশীরা জানান,
“শফিক ভাই খুব ভদ্র ও মার্জিত মানুষ ছিলেন। মেয়েকে নিয়ে কত ভালোবাসা, কোথাও যেতে হলে হাত ধরে নিয়ে যেতেন। সকালে বেরিয়ে বিকেলে ফিরতেন মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে। এমন মৃত্যু আমাদের কষ্ট দিচ্ছে।”
একজন বৃদ্ধ প্রতিবেশী আবেগঘন কণ্ঠে বলেন,
“এ মৃত্যু সহজে মেনে নেওয়া যায় না। এমন পরিবারকে এভাবে হারানো যেন নিজের পরিবারের ক্ষতি।”
শিশু নিরাপত্তা ও অভিভাবকদের সচেতনতা
এই ঘটনা আমাদের সমাজে শিশু নিরাপত্তা ও খেলাধুলার সময় অভিভাবকদের সচেতনতা নিয়ে নতুন করে ভাবনার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
-
শিশুদের কোনো ধরণের শারীরিক অনুশীলনের সময় উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি উপস্থিত থাকা আবশ্যক।
-
প্রাইভেট ক্লাবগুলোকে লাইসেন্স নবায়ন, লাইফগার্ড নিয়োগ এবং সিসিটিভি তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
-
অভিভাবকদেরও নিরাপত্তা নির্দেশিকা সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত।
প্রশাসনের পদক্ষেপ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) উত্তরা থানার ওসি জানান,
“ঘটনার তদন্ত চলছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে গাফিলতি থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ইতিমধ্যেই সুইমিং ক্লাবটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়া হবে।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শোকবার্তা
শুধু ঢাকাই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও মানুষ এই মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে। অনেকে বলেছেন, এই ঘটনা যেন আর কোনো পরিবারে না ঘটে।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন:
“একজন বাবার জীবনের শেষ সময়টা যদি হয় তার মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে... তার চেয়ে বড় ভালোবাসা আর কী হতে পারে?”
শেষকৃত্য ও শেষ বিদায়
পরদিন রবিবার সকাল ১০টায় উত্তরার বাসা থেকে দুই জনের মরদেহ একসঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয় মসজিদে জানাজার জন্য। হাজারো মানুষ অংশ নেয়। এরপর তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুরো এলাকার মানুষ এই বিদায়ের মুহূর্তে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
এক প্রতিবেশী বলেন,
“এমন মৃত্যু যেন কেউ দেখে না। মা একজন, কিন্তু সন্তান ও স্বামী হারিয়ে একা হয়ে গেলেন।”
উপসংহার: এক হৃদয়বিদারক শিক্ষা
ভিকারুননিসার ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম ও তার বাবা শফিকুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনাটি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা হলেও তা আমাদের সমাজে শিশু নিরাপত্তা, ক্লাব ব্যবস্থাপনা এবং পারিবারিক সচেতনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে যায়।
আজ তারা নেই, কিন্তু এই করুণ ঘটনার শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যতের অনেকগুলো জীবন রক্ষা করতে পারে—যদি আমরা তা উপলব্ধি করি এবং পদক্ষেপ নিই।
SEO ট্যাগসমূহ:
সাঁতার শেখাতে গিয়ে মৃত্যু, বাবা-মেয়ের করুণ মৃত্যু, ভিকারুননিসা ছাত্রী মারা গেছে, উত্তরা সুইমিং পুল দুর্ঘটনা, শিশু নিরাপত্তা, ঢাকা দুঘর্টনা, আবেগঘন মৃত্যু সংবাদ, swimming pool accident Bangladesh, tragic family story, drowning accident news.