এনা পরিবহনের দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে প্রাণ গেল সিএনজি চালকের
নিজস্ব প্রতিবেদক | ১১ জুন ২০২৫, ঢাকা:
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোড়ে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় এনা পরিবহনের দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে এক সিএনজি চালকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সকাল ৯টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত চালকের নাম মো. রফিকুল ইসলাম (৪৫)। তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়, যাত্রাবাড়ী মোড়ে ট্রাফিক সংকেত অমান্য করে বেপরোয়াভাবে প্রবেশ করছিল দুটি এনা পরিবহনের বাস। ওই সময় মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশা ওই দুই বাসের মাঝখানে পড়ে যায়। মুহূর্তেই বিকট শব্দে সংঘর্ষ হয় এবং সিএনজিটি দুমড়েমুচড়ে যায়। চালক রফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: "সবকিছু ঘটল সেকেন্ডের মধ্যে"
স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন,
“আমি তখন দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ করেই দেখি দুইটা বাস খুব দ্রুত গতিতে মোড় ঘুরছে। সিএনজিটা একেবারে তাদের মাঝখানে পড়ল। এক মুহূর্তে সব শেষ। চালক দরজার সঙ্গে আটকে যায়। তখনই বুঝলাম, বাঁচানো যাবে না।”
চালকের মৃত্যু, যাত্রী আহত
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, সিএনজিতে চালক ছাড়া আরও দুই যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন গুরুতর আহত হয়েছেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অপরজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন।
এনা পরিবহনের বাস দুইটি জব্দ, চালক আটক
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে দ্রুত উপস্থিত হয় যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। উদ্ধারকাজে যুক্ত হয়ে সিএনজি চালককে মৃত অবস্থায় বের করে আনা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় জড়িত এনা পরিবহনের দুই বাসকেই জব্দ করা হয়েছে এবং তাদের দুই চালককে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত বেপরোয়া চালনার অভিযোগে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
পুলিশের বক্তব্য
যাত্রাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন,
“এটি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছি। বাস দুটি জব্দ করা হয়েছে এবং চালকদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দুটি বাস একই রুটে যাত্রী তুলতে গিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে, এবং সেই প্রতিযোগিতার বলি হন এক নিরীহ সিএনজি চালক।”
নিহতের পরিবারের আহাজারি
নিহত রফিকুল ইসলামের মৃত্যুসংবাদে তার গ্রামের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার স্ত্রী ও তিন সন্তান রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। পরিবারের সদস্যরা বলেন,
“আমাদের মাথার ওপর ছায়া ছিল রফিক। একদিন কাজে বের হলো, আর ফিরে এল না।”
যাত্রী নিরাপত্তা ও বেপরোয়া বাস চালনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ
এই ঘটনায় এলাকাবাসী ও পথচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা প্রশ্ন তোলেন —
“কতদিন এভাবে মানুষ প্রাণ হারাবে? বাসগুলো কী মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার লাইসেন্স পেয়ে গেছে?”
দুর্ঘটনার পর কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবাড়ী মোড়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে এবং এলাকাবাসী বাসচালকদের বিচারের দাবিতে সড়কে নেমে আসে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক করে।
ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল সূত্রে তথ্য
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সুমাইয়া রহমান বলেন,
“নিহত রফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাঁর শরীরের একাধিক অঙ্গ মারাত্মকভাবে থেঁতলে গিয়েছিল। আরেকজন যাত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।”
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জানান,
“আমরা খবর পাওয়ার পর ৫ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। তবে চালক তখনই মারা গিয়েছিলেন। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।”
দ্রুত বিচার ও নিয়ন্ত্রণের দাবি
এই দুর্ঘটনা ফের প্রশ্ন তোলে শহরের গণপরিবহনের চালকদের বেপরোয়া আচরণ এবং নজরদারির ঘাটতি নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
“বাসচালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থামাতে হলে কড়া আইন প্রয়োগ এবং লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া আরও কঠোর করতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা থামবে না।”
সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর নাজমুল হক বলেন,
“দিনে দিনে যে হারে বাসচালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন, তা শুধু ট্র্যাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতাই নয়, এটি আমাদের সিস্টেমের ব্যর্থতাও প্রকাশ করে। যে চালক লাইসেন্স পায় সে কি আদৌ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত?”
উপসংহার: এক জীবনের মর্মান্তিক অবসান
এনা পরিবহনের দুই বাসের প্রতিযোগিতায় এক নিরীহ সিএনজি চালক প্রাণ হারালেন। এটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয় — এটি দেশের হাজারো সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিচ্ছবি, যেখানে সিস্টেমের ব্যর্থতা, প্রশাসনিক গাফিলতি এবং মানবিক অবহেলা একসাথে কাজ করে।
যদি দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে প্রতিদিনই রাস্তায় আরেকজন রফিকুলের মৃত্যু হবে — আর আমরা কেবল সংখ্যা গুনে যাবো।