Banner 728x90


সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সম্পত্তি জব্দ করল যুক্তরাজ্য

 


লন্ডন থেকে বিশেষ প্রতিবেদন:

দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত এক সাবেক ভূমিমন্ত্রীর নামে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত একাধিক বিলাসবহুল সম্পত্তি সম্প্রতি জব্দ করেছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইনের আওতায় পরিচালিত তদন্তে উঠে এসেছে, এই সম্পত্তিগুলো অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থে অর্জিত হয়েছে। ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি’ (NCA) এবং ‘সিরিয়াস ফ্রড অফিস’ (SFO)-এর যৌথ তদন্তে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এই ঘটনা শুধু যুক্তরাজ্যে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও শুরু হয়েছে নানাবিধ আলোচনা এবং সমালোচনা। কাদের সম্পত্তি জব্দ হয়েছে, কীভাবে এই সম্পদ বিদেশে স্থানান্তর করা হয়েছে, এবং কেন এতদিন এসব গোপন ছিল—এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো।


জব্দ হওয়া সম্পত্তির বিবরণ

ব্রিটিশ সরকারের তথ্যমতে, জব্দকৃত সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে:

  • লন্ডনের চেলসি অঞ্চলে একটি বহুতল ভবন, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ড

  • নাইটসব্রিজে অবস্থিত একটি ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট, বাজারমূল্য প্রায় ৫ মিলিয়ন পাউন্ড

  • একটি বিলাসবহুল গাড়ি— রোলস রয়েস ফ্যান্টম, যা প্রায় ৪ লাখ পাউন্ডে কেনা হয়েছিল।

  • বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা মোট ১২ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি নগদ অর্থ

এসব সম্পত্তির উৎস সম্পর্কে যথাযথ ব্যাখ্যা না দিতে পারায় সেগুলো এখন Unexplained Wealth Order (UWO)-এর আওতায় এসেছে। এই আইনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে কেউ যদি তাদের সম্পদের উৎস ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হন, তবে তা জব্দ করা হয়।


কোন দেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী?

ব্রিটিশ সরকার নাম প্রকাশে এখনো সতর্কতা অবলম্বন করলেও, বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, জব্দ হওয়া সম্পত্তির মালিক দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী। ওই ব্যক্তি এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ভূমি বণ্টন, উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ এবং সরকারি জমির অনুমোদনে।

তদন্তে উঠে এসেছে, ভূমি অধিগ্রহণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সিটি প্ল্যানিং প্রজেক্টের পেছনে থাকা কিছু চুক্তিতে অস্বচ্ছতা ছিল। ওইসব চুক্তির মাধ্যমে অর্জিত দুর্নীতির অর্থ বাইরে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।


মানি লন্ডারিংয়ের রুট এবং ব্যবহৃত পদ্ধতি

যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনার জন্য ব্যবহৃত অর্থ কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে তদন্তে উঠে এসেছে জটিল মানি লন্ডারিং চক্রের তথ্য। সন্দেহভাজন এই সাবেক মন্ত্রী এবং তার পরিবার একাধিক অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছেন।

  • অর্থ প্রথমে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণ কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

  • এরপর কেম্যান আইল্যান্ডস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এবং দুবাইয়ের কিছু শেল কোম্পানির মাধ্যমে এই অর্থ ইউরোপে প্রবেশ করানো হয়েছে।

  • সেখান থেকে মূলত লন্ডন ও ম্যানচেস্টার এলাকায় বিলাসবহুল সম্পত্তি কেনা হয়েছে।

ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, মানি লন্ডারিংয়ে ব্যবহৃত রুট অত্যন্ত ‘সফিস্টিকেটেড’ এবং এর পেছনে আন্তর্জাতিক সাইবার ও আর্থিক অপরাধচক্র সক্রিয় ছিল।


আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আইনি পদক্ষেপ

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ট্রিটি (MLAT) চুক্তির আওতায় তথ্য আদানপ্রদান হচ্ছে। তদন্তে সহায়তা করছে ইন্টারপোল, ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF) এবং EUROPOL

সাবেক মন্ত্রী এখন নিজ দেশে অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তার পাসপোর্ট ইতোমধ্যে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

আইনি জটিলতার কারণে এখনই তাকে যুক্তরাজ্যে প্রত্যর্পণ সম্ভব না হলেও, আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশে তা ভবিষ্যতে হতে পারে বলে আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।


প্রতিক্রিয়া: রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন

এই ঘটনা ঘিরে সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। বিরোধীদল এবং নাগরিক সমাজ একে "দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রতিফলন" হিসেবে উল্লেখ করেছে।

অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—

  • এত বছর ধরে এই সম্পদ কীভাবে গোপনে রাখা গেল?

  • সরকারি সংস্থাগুলো কী করছিল এতদিন?

  • দুর্নীতিবাজরা কেন এত সহজে অর্থ পাচার করতে পারছে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা বলেন, “এটি শুধু একজন ব্যক্তির নয়, পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে।”


জনগণের প্রতিক্রিয়া

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। অনেকেই ব্রিটিশ সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং নিজেদের দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করছেন।

একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন—
“ব্রিটেনে যেটা সম্ভব, আমাদের দেশে সেটা কেন সম্ভব নয়? দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়!”

অন্য একজন টুইটারে বলেন—
“যতদিন না দেশীয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে, ততদিন এরা এই দেশকে নিঃশেষ করে দেবে।”


বিশ্লেষণ: কী শেখার আছে এই ঘটনার মাধ্যমে?

এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:

  1. দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জিরো টলারেন্স নীতি।

  2. সব সরকারি কর্মকর্তার সম্পদের উৎস যাচাই ও প্রকাশ।

  3. অফশোর অ্যাকাউন্ট ও ফেক কোম্পানি মনিটরিং করা।

  4. মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে সাইবার প্রযুক্তি ও এআই ব্যবহারের মাধ্যমে নজরদারি বৃদ্ধি।


উপসংহার

যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সম্পত্তি জব্দের ঘটনা একটি নিছক আইনি পদক্ষেপ নয়; এটি দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের একটি মাইলফলক। এটি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে— দেরিতে হলেও, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

অতএব, দুর্নীতিবাজরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো ও গণচাপের মুখে তারা একদিন ঠিকই ধরা পড়ে।
প্রশ্ন এখন একটাই—এই ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দেশ কি নিজেদের ঘরদোর গুছিয়ে নেবে?


সংবাদ বিশ্লেষক: রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, যুক্তরাজ্যের সরকারিভাবে প্রকাশিত নথি, এবং মানি লন্ডারিং বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে।

প্রকাশকাল: ১১ জুন ২০২৫

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url