সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তরুণ, মায়ের শোকে হৃদয়বিদারক দৃশ্য
ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঘটলো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা
ঢাকার কাকরাইল মোড়ে দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক সড়ক দুর্ঘটনা। মায়ের চোখের সামনে একটি দ্রুতগামী প্রাইভেটকারের ধাক্কায় প্রাণ হারায় ২১ বছর বয়সী তরুণ আশিকুল ইসলাম। এই মর্মান্তিক ঘটনায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যান তার মা নাজমা বেগম। সবার সামনে ঘটে যাওয়া এই দৃশ্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে।
বিকট শব্দ, তারপর নিথর দেহ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আশিকুল ইসলাম তার মায়ের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিলেন ফুটপাথ দিয়ে। হঠাৎ এক বেপরোয়া প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উঠে পড়ে ফুটপাথে। মুহূর্তেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানবদেহ। গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান আশিক। ভয়ার্ত হয়ে পড়ে গোটা এলাকা।
তরুণ আশিকের পরিচয় ও জীবনগল্প
নিহত আশিকুল ইসলাম ঢাকা কলেজের বিবিএ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মেধাবী, ভদ্র ও সদালাপী ছেলেটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল একদিন একজন বড় ব্যবসায়ী হবেন। বাবাকে হারিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। তখন থেকেই সংসারের বড় দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে।
নাজমা বেগম, আশিকের মা, একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ছেলের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসার সামলাতেন একাই। মা-ছেলের বন্ধনের ছিল এক অসাধারণ সম্পর্ক।
দুর্ঘটনার সময়কার হৃদয়বিদারক মুহূর্ত
দুর্ঘটনার সময় আশিক তার মাকে অফিস পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিল। আচমকা ঘটে যাওয়া এ দুর্ঘটনার পর নাজমা বেগম ছেলের নিথর দেহ আঁকড়ে ধরে ছুটে যান রাস্তায়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে থাকেন, "আমারে নিয়া যাস না মা গো! আমারে একা ফালাইয়া গেলি ক্যান?" আশপাশের মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
এক প্রত্যক্ষদর্শী মো. রবিউল জানান, "ছেলেটার মাথা ফেটে গেছিল। মা যেভাবে কাঁদছিলেন, সেই কান্না সারাটা শহর শুনলেও অবাক হতো না। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য জীবনে দেখি নাই।"
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের পদক্ষেপ
খবর পেয়ে রমনা থানা পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আশিকের মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। গাড়ির চালককে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
চালকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা
পুলিশ জানায়, গাড়িটির চালকের নাম মো. কামরুল হাসান, বয়স আনুমানিক ৩২। তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। রমনা থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, “চালকের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত হত্যার মামলা রুজু করা হয়েছে। গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।”
মায়ের অবস্থার অবনতি, হাসপাতালে ভর্তি
নাজমা বেগমকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মানসিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি ‘ট্রমাটিক শকে’ ভুগছেন। মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে কান্না করছেন। বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেহজাবীন রহমান বলেন, “এমন আকস্মিক সন্তানহানিতে মায়ের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল। আমরা তাকে মনোবিদের তত্ত্বাবধানে রেখেছি।”
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ ও সহানুভূতির ঝড়
এই মর্মান্তিক ঘটনার ভিডিও ও ছবি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেকেই সরকারের প্রতি সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জোর দাবি জানান। হ্যাশট্যাগ #JusticeForAshiq ট্রেন্ড করতে শুরু করে।
নানান জনতার মন্তব্য:
-
সাবিনা ইয়াসমিন: “এটা শুধু একটা দুর্ঘটনা নয়, এটা আমাদের প্রশাসনের ব্যর্থতা। এমন চালকদের লাইসেন্স কে দেয়?”
-
রাকিব হোসেন: “মায়ের কান্না যেন কানের ভেতর বাজছে। আর কোনো আশিক যেন এমনভাবে না হারায়।”
নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা পরদিনই রাস্তায় নেমে আসে। তারা নাজমা বেগমের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং আশিকুল ইসলামের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের ব্যানারে তারা শাহবাগ মোড়ে মানববন্ধন করে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, “আমরা আর কাউকে এইভাবে হারাতে চাই না। আমাদের ভাইদের, বন্ধুদের রক্ষা করতে হলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত: কেন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা?
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. খালেদ মাহমুদ জানান, “ঢাকায় প্রতিদিন ২০টির বেশি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর মূল কারণ দ্রুতগতির যানবাহন, অপ্রশিক্ষিত চালক, ট্রাফিক নিয়ম অমান্য এবং কার্যকর আইন প্রয়োগের অভাব।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও প্রতিশ্রুতি
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক বিবৃতিতে বলেন, “এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের ট্রাফিক ইউনিটকে আরও সক্রিয় করা হয়েছে।”
মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়ালেন অনেকে
বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাজমা বেগমের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন একাধিক সহযোগিতা তহবিল খোলার উদ্যোগ নেয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যও নাজমা বেগমকে সমবেদনা জানান এবং আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
একটি প্রশ্ন: নিরাপদ সড়ক কবে আসবে?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক নিত্যদিনের যন্ত্রণা। আশিকুল ইসলামের মৃত্যু শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি হাজারো পরিবারের আর্তনাদের প্রতিফলন। তার মায়ের কান্না আমাদের বিবেককে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন—আর কত প্রাণ গেলে, আর কত মায়ের চোখ শুকিয়ে গেলে আমরা নিরাপদ সড়ক পাবো?