নতুন গবেষণা বলছে: শিশুদের খারাপ আচরণের কারণ ও লক্ষণ—দুটোই হতে পারে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম
ভূমিকা
বর্তমান যুগে শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ ও টেলিভিশনের মতো স্ক্রিনভিত্তিক ডিভাইস। অভিভাবকরা অনেক সময় নিজেদের কাজ সামলাতে গিয়ে বা শিশুদের শান্ত রাখতে এই স্ক্রিনের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা নতুন করে প্রশ্ন তুলছে—এই স্ক্রিন টাইম কি কেবল বিনোদন নাকি শিশুদের মানসিক ও আচরণগত বিকাশে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে?
গবেষণার মূল ফলাফল
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ও শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞদের পরিচালিত এই গবেষণাটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে Journal of Child Psychology and Psychiatry-তে। গবেষকরা প্রায় ১০,০০০ শিশুর আচরণ, আবেগীয় স্বাস্থ্য এবং তাদের দৈনিক স্ক্রিন ব্যবহারের ওপর বিশ্লেষণ চালিয়ে দেখতে পান, স্ক্রিন টাইম কেবল শিশুদের খারাপ আচরণের কারণ নয়, বরং এটি খারাপ আচরণের একটি লক্ষণও হতে পারে।
অর্থাৎ, যেসব শিশু ইতোমধ্যে মানসিক চাপ বা আচরণগত সমস্যায় ভুগছে, তারা আরও বেশি স্ক্রিনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে—এবং স্ক্রিন ব্যবহার বেড়ে গেলে তাদের আচরণ আরও খারাপ হয়। এটি একধরনের চক্রাকারে চলা সংকট, যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম ও আচরণগত সমস্যা: কী কী সম্পর্ক পাওয়া গেছে
গবেষণায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
-
আগ্রাসী আচরণ: যেসব শিশু দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় স্ক্রিনে কাটায়, তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ, রেগে যাওয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ প্রকাশের প্রবণতা বেশি।
-
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কারণে শিশুরা পারিবারিক মেলামেশা ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহ হারায়।
-
মনোযোগের অভাব ও শিক্ষাগত ক্ষতি: ক্লাসে মনোযোগ কম, পড়ালেখায় আগ্রহহীনতা ও একাগ্রতা হারানোর মতো উপসর্গগুলো স্ক্রিন টাইম বাড়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
-
ঘুমের ব্যাঘাত: রাতে স্ক্রিন দেখার কারণে ঘুমের পরিমাণ কমে যায়, যা শিশুদের সারাদিন ক্লান্ত, খিটখিটে এবং বিষণ্ন করে তোলে।
স্ক্রিনটাইম কি আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে?
গবেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা ডিজিটাল স্ক্রিনে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে তা একপ্রকার “ডিজিটাল অ্যাডিকশন” বা স্ক্রিন আসক্তিতে রূপ নেয়। এই আসক্তি থেকে জন্ম নেয় একঘেয়েমি, বাস্তব জীবনের প্রতি আগ্রহ হারানো, এবং খেলার মাঠ বা সামাজিক পরিবেশ এড়িয়ে চলার প্রবণতা।
বিশেষজ্ঞরা এটিকে মাদকাসক্তির সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, "মস্তিষ্কের ডোপামিন ক্ষরণকে ট্রিগার করার জন্য যেভাবে মাদক কাজ করে, ঠিক তেমনভাবেই স্ক্রিনে অ্যাকশন, কার্টুন, গেম বা ইউটিউব ভিডিও শিশুদের তৎক্ষণাৎ আনন্দ দেয়—যা ক্রমে নেশায় পরিণত হয়।"
স্ক্রিনটাইম কি সমস্যার লক্ষণও হতে পারে?
গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই যে, শিশুর অতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহার অনেক সময় তার মানসিক চাপ, দুঃখ, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বা পারিবারিক সমস্যার প্রতিফলন হিসেবেও দেখা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:
-
বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিবাহবিচ্ছেদে আক্রান্ত শিশুরা স্ক্রিনে ডুবে গিয়ে বাস্তবতা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
-
যারা স্কুলে বন্ধুবিচ্ছিন্ন বা বুলিংয়ের শিকার, তারা অনলাইনে ভার্চুয়াল বন্ধুর মাঝে সান্ত্বনা খোঁজে।
-
অভিভাবকদের পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া শিশুরা স্ক্রিনে মানসিক প্রশ্রয় খুঁজে পায়।
এই দিকটি বুঝে ব্যবস্থা না নিলে, অভিভাবক হয়তো স্ক্রিনটাইম কমিয়ে দিলেও সমস্যার মূল কারণ থেকে যাচ্ছে অরক্ষিত।
স্ক্রিন ব্যবহারের পেছনে বাবা-মায়ের ভূমিকা
গবেষণার একাধিক পর্বে দেখা গেছে, অভিভাবকদের নিজেরাও যদি অতিরিক্ত সময় স্ক্রিনে ব্যয় করেন (যেমন: মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়ায়), তাহলে শিশুরাও সেটি অনুসরণ করে। আবার অনেকেই শিশুকে শান্ত রাখতে স্ক্রিন ধরিয়ে দেন, যা প্রথমে কার্যকর মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকদের উচিত—
-
শিশুর সঙ্গে সময় কাটানো
-
একসঙ্গে খেলা, গল্প শোনা বা ড্রয়িং করা
-
পরিবারে নিয়মিত স্ক্রিনফ্রি সময় চালু করা
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: কী করা উচিত
গবেষকদের মতে, শিশুরা যেন স্বাস্থ্যকর স্ক্রিন অভ্যাস গড়ে তোলে, সে লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:
-
সময় নির্ধারণ: দিনে সর্বোচ্চ ১ থেকে ১.৫ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন সময় যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
-
সার্বক্ষণিক মনিটরিং: শিশুরা কী ধরনের কনটেন্ট দেখছে, তা সবসময় নজরে রাখতে হবে। সহিংসতা বা অশ্লীল কনটেন্ট থেকে দূরে রাখতে হবে।
-
ঘুম ও খাবারের সময় স্ক্রিন নয়: খাবার ও ঘুমের সময় স্ক্রিন ব্যবহারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জরুরি।
-
স্ক্রিনের বিকল্প দিন: বই পড়া, ঘরোয়া খেলা, গান শেখা বা বাইরের পরিবেশে সময় কাটানো যেন শিশুর দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়।
-
মডেলিং: বাবা-মাকে নিজেরাও স্ক্রিন ব্যবহারে সংযমী হতে হবে, যাতে শিশুরা অনুসরণ করতে পারে।
উপসংহার
নতুন গবেষণার আলোকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, শিশুদের আচরণগত সমস্যা শুধু স্ক্রিন টাইমের কারণ নয়, বরং এটি সেই সমস্যার উপসর্গও হতে পারে। তাই কেবল স্ক্রিন প্রতিরোধ করলেই হবে না, বরং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবারিক পরিবেশ এবং সামাজিক আচরণের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।
আজকের দিনে প্রযুক্তিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তবে সেটা নিয়ন্ত্রিত ও সুস্থ উপায়ে ব্যবহারের শিক্ষা দেওয়াই অভিভাবকদের মূল দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, স্ক্রিন কখনো শিশুর প্রকৃত বিকাশের বিকল্প হতে পারে না। আর সময় মতো সচেতন না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক ও সামাজিক বিকাশ বড় ধরণের হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সূত্র:
-
Journal of Child Psychology and Psychiatry, 2025
-
American Academy of Pediatrics
-
Harvard Child Development Center
শিরোনাম:
নতুন গবেষণা বলছে: শিশুদের খারাপ আচরণের কারণ ও লক্ষণ—দুটোই হতে পারে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম
উপশিরোনাম:
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের মানসিক বিকাশে বাঁধা সৃষ্টি করছে, বলছে সাম্প্রতিক গবেষণা। আচরণগত সমস্যা ও স্ক্রিন আসক্তির মাঝে রয়েছে পারস্পরিক সম্পর্ক।
প্রতিবেদক:
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ঢাকা, ১০ জুন:
বর্তমান ডিজিটাল যুগে শিশুদের মধ্যে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ ও টেলিভিশনের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। অভিভাবকেরা যেমন শিশুদের শান্ত রাখতে স্ক্রিন ব্যবহার করাচ্ছেন, তেমনি শিশুরাও এর প্রতি ভয়ংকরভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তবে সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে একটি নতুন ও চমকে দেওয়া তথ্য—অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম কেবল শিশুদের খারাপ আচরণের কারণই নয়, বরং তা ওই আচরণেরই একটি উপসর্গও হতে পারে।
গবেষণার বিস্তারিত:
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই গবেষণা Journal of Child Psychology and Psychiatry-তে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার শিশুর তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পান, যারা দিনে তিন ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনে সময় কাটায়, তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মকতা, মানসিক অস্থিরতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও মনোযোগের ঘাটতির প্রবণতা রয়েছে।
আচরণগত লক্ষণসমূহ:
-
আগ্রাসী আচরণ: সহজেই রেগে যাওয়া, মারধর করা বা চিৎকার করা।
-
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না চাওয়া।
-
ঘুমের ব্যাঘাত: রাতজাগা বা ঘুম কমে যাওয়া।
-
পড়ালেখায় মনোযোগের অভাব: একাগ্রতা কমে যাওয়া ও শিক্ষাগত ফলাফল খারাপ হওয়া।
স্ক্রিন আসক্তি এবং শিশু মনঃস্বাস্থ্য:
গবেষকরা বলছেন, এই স্ক্রিন ব্যবহারের মধ্যে অনেক সময় শিশুর অব্যক্ত মানসিক যন্ত্রণা, পরিবারিক সংকট বা দুঃখবোধ লুকিয়ে থাকে। বিশেষ করে যেসব শিশু বাবা-মায়ের তিক্ত সম্পর্ক, বিবাহবিচ্ছেদ বা স্কুল বুলিংয়ের শিকার—তারা বাস্তবতা থেকে পালিয়ে ভার্চুয়াল জগতে সান্ত্বনা খোঁজে।
এভাবে স্ক্রিন ব্যবহার ধীরে ধীরে একধরনের "ডিজিটাল আসক্তি"-তে পরিণত হয়। এতে শিশুর মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে আনন্দের নির্ভরশীলতা তৈরি করে। অনেকটাই যেন মাদকাসক্তির মতো!
অভিভাবকের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর স্ক্রিন টাইম কমাতে হলে অভিভাবকদের আগে নিজেদের স্ক্রিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তারা যেভাবে আচরণ করেন, শিশুরাও তাই শেখে।
প্রস্তাবিত করণীয়:
ঘুম, খাওয়া ও পড়ার সময় স্ক্রিন সম্পূর্ণ বন্ধ
পরিবারের সবাই মিলে “স্ক্রিন-ফ্রি টাইম” পালন
বিকল্প গঠনমূলক কার্যকলাপ (বই, খেলা, গান, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদিউপসংহার:
গবেষণাটি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। স্ক্রিন শুধু বিনোদন নয়—তার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে শিশুর মানসিক চাপ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা বা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। তাই এখন সময়, শিশুর আচরণকে বোঝার চেষ্টা করার এবং স্ক্রিনের পেছনের গল্পটি জানার।
শুধু স্ক্রিন বন্ধ করলেই হবে না, বরং শিশুর হৃদয়ে প্রবেশ করে তার প্রকৃত চাহিদাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানসিকভাবে সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলতে এটাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ।
সূত্র:
-
Journal of Child Psychology and Psychiatry, ২০২৫
-
আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স
-
হার্ভার্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার