মুহূর্তের অসতর্কতায় বালু নদীতে ডুবে গেলেন সৃজন
ঢাকা, ১৮ জুন ২০২৫:
কনটেন্ট তৈরির নেশাই যেন কাল হলো
সাক্ষাৎকারে সৃজনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান,
“আমরা কয়েকজন মিলে বিকেলে বালু নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম শর্ট ভিডিও বানাতে। সৃজন একটি রিল ভিডিও করতে করতে পায়ের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পানিতে পড়ে যায়। সে সাঁতার জানতো না, আমরা চেষ্টা করেও ওকে বাঁচাতে পারিনি।”
ভিডিও তৈরির সময় এক বন্ধুর মোবাইলে ধারণ করা দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যায়, সৃজন হালকা হাসির ভিডিওর শুটিং করছিলেন, এমন সময় আচমকাই পেছনের দিকের ঢালু পাড় থেকে পানিতে পড়ে যান।
কে ছিলেন সৃজন?
সৃজন হোসেন (২২) একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ অধ্যয়নরত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ইউটিউব, টিকটক ও ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করতেন। তার 'Srijon Vibes' নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল ছিল, যেখানে প্রায় ৩০ হাজার সাবস্ক্রাইবার ছিল। তার অনেক ভিডিও মিলিয়নের বেশি ভিউ পেয়েছে।
সৃজনের এক আত্মীয় জানান,
“সে খুব প্রতিভাবান ছিল। ভিডিও বানানো ছিল ওর নেশা। কিন্তু কে জানতো এই নেশাই ওর জীবন কেড়ে নেবে।”
উদ্ধার অভিযান
ঘটনার পরপরই এলাকাবাসী ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস ও ডুবুরি দল প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় সৃজনের মরদেহ উদ্ধার করে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন:
“নদীর অংশটায় হঠাৎ গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সহজেই ভারসাম্য হারাতে পারে। সে সাঁতার না জানার কারণে দ্রুত ডুবে যায়।”
ভিডিও ভাইরাল, নেটদুনিয়ায় শোকের ছায়া
সৃজনের পানিতে পড়ার সেই মুহূর্তটি ভিডিওতে ধারণ হয় এবং বন্ধুদের কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে তা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে দেয়। ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারো মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ লিখেছেন—
“কনটেন্টের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে আরেকটা তরুণ প্রাণ হারিয়ে গেল।”
অন্য একজন মন্তব্য করেন—
“এ ধরনের ভিডিও করতে গিয়ে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। এটা থামাতে হবে।”
পরিবারে শোকের মাতম
সৃজন ছিলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়। তার বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, মা গৃহিণী। ছেলের এমন অকাল মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
তার মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন, বলছিলেন:
“ছেলে তো বাইরে ভিডিও করতে গিয়েছিল, আমি ওকে বলেছিলাম সন্ধ্যার আগে যেন বাড়ি আসে... ও আর ফিরলো না।”
বিশেষজ্ঞদের মত
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, তরুণদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট তৈরির প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে, যা একদিকে সৃজনশীলতার জায়গা তৈরি করলেও, অন্যদিকে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকিয়া হক বলেন,
“সন্তানরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে—এটা অভিভাবকদের নিয়মিত জানার চেষ্টা করতে হবে। ভিডিও বানানোর জায়গায় নিরাপত্তা আছে কি না, সে বিষয়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
“আমরা চেষ্টা করবো নদীপাড় এলাকায় নিরাপত্তা বেড়াজাল তৈরি করতে। প্রয়োজনে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে একটি সচেতনতা টিম গঠন করবো।”
সৃজনের মৃত্যু একটি করুণ বাস্তবতা তুলে ধরেছে—অল্প বয়সী তরুণরা কনটেন্ট তৈরির নামে নিজেদের বিপদে ফেলছে। সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। শুধু জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে, জীবনের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।