এবার নীরবতা ভেঙে ইরানের পাশে হিজবুল্ল
এবার নীরবতা ভেঙে ইরানের পাশে হিজবুল্ল
মধ্যপ্রাচ্য যেন এক বিস্ফোরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরি। প্রতিদিনই নতুন করে বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান টানাপড়েন এখন শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব থেকে শুরু করে কাতার, তুরস্ক এমনকি চীন পর্যন্ত নজর রেখেছে এই সংঘাতের দিকে।
এই পরিস্থিতিতে এক দীর্ঘ নীরবতার পর এবার সরব হয়েছে লেবাননের শিয়াপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী **হিজবুল্লাহ**। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা জানিয়ে তারা প্রকাশ্যে বলেছ আমরাও প্রস্তুত। ইরান একা নয়।
এই ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য। পর্দার আড়ালে এতদিন যেসব হিসাবনিকাশ চলছিল, এবার হয়ত প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিতে চলেছে।
গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল একের পর এক হামলা চালিয়েছে সিরিয়া, ইরাক এবং ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায়। এর মধ্যে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ও বিপ্লবী গার্ডদের ঘাঁটিও রয়েছে। এসব হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ইরানের অন্তত ১২ জন শীর্ষপর্যায়ের বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তা।
ইরানও প্রতিশোধ নিতে দেরি করেনি। ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন এবং রকেট ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালানো হয় ইসরায়েলের ভূখণ্ডে। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ঘাঁটিগুলোও পড়েছে ইরানের নিশানায়।
এই সংঘাতে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা এবং তেলের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এমন সময়েই হিজবুল্লাহর ঘোষণাকে বিশ্লেষকরা দেখছেন একটি “টার্নিং পয়েন্ট”
হিসেবে।
হিজবুল্লাহর নীরবতা ও তা ভাঙার কারণ
ইরান ও হিজবুল্লাহর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইরান মূলত হিজবুল্লাহকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে।
তবে চলমান সংঘাতের শুরু থেকে হিজবুল্লাহ বেশ নীরব ছিল। কেউ কেউ ভেবেছিলেন হয়ত তারা এখন কৌশলগত অবস্থানে।
কিন্তু ১৮ জুন এক ভিডিও বার্তায় হিজবুল্লাহর মহাসচিব **হাসান নাসরাল্লাহ** বলেন,
আমরা নীরব ছিলাম পরিস্থিতির পরিপক্বতা দেখার জন্য। কিন্তু এখন সময় এসেছে রুখে দাঁড়াবার। ইরানের ওপর হামলা মানেই গোটা প্রতিরোধ ফ্রন্টের ওপর হামলা।
এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি শুধু ইরানের প্রতি সমর্থন জানাননি, বরং স্পষ্ট করে দিয়েছেন— হিজবুল্লাহ সামরিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে।
লেবাননের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া
হিজবুল্লাহর এমন ঘোষণার পর লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন উত্তেজনা।
প্রধানমন্ত্রী নাজীব মিকাতিবলেন:
লেবানন যুদ্ধ চায় না। তবে আমরা প্রতিবেশীদের পাশে আছি।
অন্যদিকে বিরোধী জোট বলছে,
হিজবুল্লাহ একতরফাভাবে পুরো দেশকে বিপদে ঠেলে দিচ্ছে। লেবাননের জনগণ এর দায় নেবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হিজবুল্লাহর প্রভাব ব্যাপক। ফলে তারা চাইলেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে দেশটিকে, যদিও তা আনুষ্ঠানিক সরকারের মত নয়।
সামরিক প্রস্তুতি: সীমান্তে হিজবুল্লাহর তৎপরতা
ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে ইতোমধ্যেই হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রামে দেখা গেছে অস্ত্রসহ সজ্জিত ইউনিটদের।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে
হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে ৩০টিরও বেশি রকেট লঞ্চার মোতায়েন করেছে এবং যুদ্ধকালীন ইউনিটগুলোকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এর মুখপাত্র বলেন
আমরা হিজবুল্লাহর প্রতি চোখ রাখছি। কোনো ধরনের আক্রমণের চেষ্টা করা হলে তার কঠোর জবাব দেওয়া হবে।
এরপরই ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন সীমান্তে ড্রোন ও যুদ্ধবিমান টহল বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
হিজবুল্লাহর ঘোষণার পরপরই জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উদ্বেগ জানিয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসবলেছেন
আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ চাই না। হিজবুল্লাহকে সংযত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবি** বলেন
হিজবুল্লাহর এমন ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে। ইসরায়েল আত্মরক্ষায় যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে।
এদিকে রাশিয়া ও চীন নীরব ভূমিকা নিচ্ছে। তারা স্পষ্ট কোনো মন্তব্য না করলেও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ এর শক্তি
হিজবুল্লাহ, হামাস, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী এবং ইরাক-সিরিয়ার কিছু মিলিশিয়া দল মিলে গঠিত হয়েছে একটি অনানুষ্ঠানিক সামরিক বলয়‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’
এই বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছে ইরান। লক্ষ্য একটাই ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
হিজবুল্লাহর এই সাম্প্রতিক সক্রিয়তা এই বলয়কে আরও মজবুত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন,
এই মুহূর্তে ইসরায়েলকে শুধু ইরান নয়, গোটা প্রতিরোধ ফ্রন্টের মুখোমুখি হতে হবে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে: যুদ্ধ কি অনিবার্য?
রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হিজবুল্লাহর সক্রিয়তা সংঘাতের পরিধি বাড়াবে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ড. সাদেক আল-মুসাভি বলেন
ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যদি সরাসরি সংঘর্ষ হয়, তাহলে পুরো লেবানন জুড়েই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতি ইরানকে সরাসরি মাঠে নামতে বাধ্য করবে।
তবে অনেকেই মনে করছেন, এখনো কূটনীতির সুযোগ রয়েছে। তবে সেটি ক্ষণস্থায়ী হতে পারে।
পরিস্থিতির আপডেট (২০ জুন, ২০২৫)
* হিজবুল্লাহ দক্ষিণ সীমান্তে মিসাইল লঞ্চার স্থাপন করেছে
* ইসরায়েল সীমান্তবর্তী গ্রামে বোমা হামলার আশঙ্কায় বাসিন্দাদের সরিয়ে নিচ্ছে
* জাতিসংঘ সীমান্তে যুদ্ধবিরতি তদারকিতে বিশেষ দল পাঠাচ্ছে
* ইরান বলেছে— “হিজবুল্লাহ কী করবে, তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে আমরা এক ফ্রন্টে আছি।”
উপসংহার: কূটনীতি না যুদ্ধ— কোন পথে মধ্যপ্রাচ্য?*
হিজবুল্লাহর নীরবতা ভাঙার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য যেন আরেকটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।বিশ্ব সম্প্রদায় এখন প্রশ্নের মুখে
* ইরান-ইসরায়েলের এই দ্বন্দ্ব কি এখন একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে?
* হিজবুল্লাহ কি শুধু হুমকি দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সরাসরি মাঠে নামবে?
* যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি সত্যিই নিষ্ক্রিয় থাকবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্ভর করছে আগামী কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহের ওপর। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট ইরান এখন আর একা নয়। হিজবুল্লাহ তার পাশে দাঁড়িয়েছে l
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যেখানে এক সেকেন্ডে দৃশ্যপট বদলে যায়, সেখানে হিজবুল্লাহর এই পদক্ষেপকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
বিশ্ববাসী এখন তাকিয়ে— কোন দিকে মোড় নেয় ইরান-ইসরায়েল নাটকীয়তা, আর তাতে হিজবুল্লাহ কতটা সক্রিয় হয়।
আল-জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি, প্রেস টিভি, আইডিএফ মিডিয়া সেন্টার।