Banner 728x90


২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ৯ দফা ইরানের মিসাইল হামলা

  ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ৯ দফা ইরানের মিসাইল হামলা

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি মিসাইল হামলার ঘটনা। বিগত ২৪ ঘণ্টায় ইরান থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন কৌশলগত স্থাপনাকে লক্ষ্য করে ৯ দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলাগুলোর বেশিরভাগই ছিল দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল, যেগুলো ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।
এত স্বল্প সময়ের মধ্যে একাধিক হামলা ইসরায়েলকে কৌশলগত, সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিপাকে ফেলেছে বলে ধারণা করছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।


 প্রথম দফা হামলা: তেলআবিব লক্ষ্য করে রাত ২টা

স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে ইরান থেকে ছোঁড়া হয় প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইল। লক্ষ্য ছিল তেলআবিব শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত রামাত হাশারন সামরিক ঘাঁটি। ইসরায়েল দাবি করেছে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘এরো-৩’ এবং ‘ডেভিডস স্লিং’ এর সহায়তায় তারা এই হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। তবে ইরানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফার্স নিউজ দাবি করেছে, হামলায় একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।


 দ্বিতীয় দফা হামলা: ভোর ৫টায় হাইফার তেল শোধনাগার

এর তিন ঘণ্টা পর, ইরান হাইফা শহরের তেল শোধনাগার লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এখানে ব্যবহৃত হয় মাঝারি পাল্লার ক্রুজ মিসাইল। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো বন্দরনগরী। হাইফার জরুরি সেবা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগুনে বেশ কয়েকটি তেলের ট্যাংকার পুড়ে যায় এবং অন্তত ১২ জন আহত হন। এলাকাটি সাময়িকভাবে ‘নো-এন্ট্রি জোন’ ঘোষণা করে সেনাবাহিনী।


 তৃতীয় ও চতুর্থ দফা: সকাল ৮টা ও ১১টা — আশকেলন ও দিমোনা

সকাল ৮টায় আশকেলন শহরের একটি সামরিক সরঞ্জামাগার লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। বেসামরিক এলাকাগুলোতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয় এবং সাধারণ মানুষ আতঙ্কে পালিয়ে যায়।
অপরদিকে সকাল ১১টায় ইরান দিমোনা পারমাণবিক স্থাপনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আঘাত হানে একটি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র। যদিও সরাসরি দিমোনাকে টার্গেট করা হয়নি, তবে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একে সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখছেন।


 পঞ্চম দফা হামলা: দুপুর ১টা — নেভাতিম বিমান ঘাঁটি

ইসরায়েলের নেভাতিম বিমান ঘাঁটি, যেখানে এফ-৩৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন থাকে, সেখানে ইরান একটি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন ও ব্যালিস্টিক মিসাইল পাঠায়। ক্ষেপণাস্ত্রটি ঘাঁটির মূল রাডার স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম হয় বলে খবর। এতে অন্তত ৪ জন ইসরায়েলি সেনা আহত হয়েছেন এবং ঘাঁটির একটি রানওয়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


 ষষ্ঠ থেকে অষ্টম দফা: বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত

বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে একের পর এক ৩টি হামলা চালায় ইরান।

  1. বিকেল ৩টায় গালিলি অঞ্চলের একটি সামরিক যোগাযোগ টাওয়ার লক্ষ্য করে মিসাইল ছোঁড়া হয়।

  2. বিকেল ৫টায় ইসরায়েলি সাইবার কমান্ড সেন্টারকে লক্ষ্য করে একটি দূরপাল্লার মিসাইল হামলা হয়।

  3. সন্ধ্যা ৭টায় বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশেপাশে বিস্ফোরণ হয়, যদিও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি।

এই তিনটি হামলার মধ্য দিয়ে ইরান দেখিয়েছে যে, শুধু সামরিক নয়, বেসামরিক অবকাঠামোও তাদের টার্গেটে রয়েছে।


 নবম ও সর্বশেষ দফা হামলা: রাত ৯টা — তেলআবিবের কেন্দ্রস্থলে বিস্ফোরণ

রাত ৯টার দিকে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয় তেলআবিব শহরের কেন্দ্রস্থলে। যেখানে একটি প্রধান প্রশাসনিক ভবনে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে। ইসরায়েলি পুলিশ এবং চিকিৎসা সংস্থা জানায়, এতে অন্তত ১৮ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এই হামলার পর তেলআবিবে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয় এবং সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয় শহরের রাস্তায়।


 হামলার ধরন ও প্রযুক্তি বিশ্লেষণ

বিগত ২৪ ঘণ্টার এই ৯ দফা হামলায় ইরান যে মিসাইল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তা নিম্নরূপ:

  • শাহাব-৩ ব্যালিস্টিক মিসাইল (২০০০ কিমি পাল্লা)

  • ফাতেহ-১১০ (স্বল্প পাল্লার দ্রুতগামী মিসাইল)

  • ক্রুজ মিসাইল 'সুমার'

  • শাহেদ-১৩৬ কামিকাজে ড্রোন

  • ইলেকট্রনিক জ্যামিং ও সাইবার হামলার প্রচেষ্টা

এগুলো ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ‘আয়রন ডোম’, ‘ডেভিডস স্লিং’, ‘এরো সিস্টেম’কে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। একসঙ্গে এতগুলো হামলা ঠেকাতে গিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রবল চাপ পড়ে গেছে।


 ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন,

"আমরা এই বর্বরোচিত হামলার কড়া জবাব দেব। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সজাগ আছে। ইরানকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, এই আগ্রাসনের মূল্য তাদের চরমভাবে দিতে হবে।"

ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (IDF) দাবি করেছে, তারা অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে, তবে কিছু ‘ফাঁকি দিয়ে’ লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছেছে বলে স্বীকার করেছে। এরই মধ্যে তারা ইরানের কয়েকটি রাডার ও ড্রোন ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।


🇮🇷 ইরানের বক্তব্য

ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড (IRGC) এই ৯ দফা হামলাকে “অপারেশন শাফাফ-২” নামে অভিহিত করেছে।
তারা বলেছে,

"ইসরায়েল আমাদের বিজ্ঞানী, সেনা ও সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। আমরা এই অন্যায়ের জবাব দিচ্ছি। প্রতিরক্ষা নয়, এটা আমাদের সম্মান রক্ষার যুদ্ধ।"


আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ এই হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করছে।
তবে ইরান ও ইসরায়েল যেভাবে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছে, তাতে বড় আকারের যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞ মহল।


 বাণিজ্যিক ও সামাজিক প্রভাব

হামলার প্রভাব পড়েছে ইসরায়েলের স্টক মার্কেটেও। তেলআবিব স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধরনের পতন লক্ষ্য করা গেছে। তেল, গ্যাস ও প্রযুক্তি খাতে শেয়ারের দর কমেছে ৬-১০ শতাংশ পর্যন্ত।
বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে, স্কুল, হাসপাতাল ও সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।


 উপসংহার

২৪ ঘণ্টায় ৯ দফা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে ইরান স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে— তারা এখন কূটনৈতিক নয়, সামরিক সমাধানে বিশ্বাসী। ইসরায়েল এই আক্রমণকে আগ্রাসন হিসেবে দেখছে, এবং প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে চলেছে।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে, মধ্যপ্রাচ্য আর শুধু উত্তপ্ত অঞ্চল নয়, একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিতে পারে।
বিশ্ববাসী এখন তাকিয়ে আছে— এই সংঘাত কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, এবং নতুন একটি বিশ্বযুদ্ধ কি তবে শুরু হতে চলেছে?



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url