ইসরায়েলি হামলায় ইরানের শীর্ষ ১২ পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু: তেহরানে শোক, বিশ্বে উদ্বেগ
ভূমিকা
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার নতুন এক অধ্যায় সূচিত হলো। ইসরায়েলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের শীর্ষ ১২ পরমাণু বিজ্ঞানীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। এই হামলাকে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে এক "সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত নাশকতা" বলে অভিহিত করেছে। ঘটনাটি শুধু ইরান নয়, পুরো বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ঘটনার বিস্তারিত
২০২৫ সালের ১২ জুন, স্থানীয় সময় রাত প্রায় ৩টা ২০ মিনিটে, তেহরান ও ইস্পাহানের মাঝামাঝি একটি গবেষণা কমপ্লেক্সে ইসরায়েলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র একযোগে হামলা চালায়। টার্গেট ছিল অত্যন্ত গোপনীয় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র—যেখানে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা নিয়মিত কাজ করতেন।
হামলায় মুহূর্তেই বিধ্বস্ত হয়ে যায় কমপ্লেক্সটির প্রধান ল্যাব ও একটি আন্ডারগ্রাউন্ড রিঅ্যাক্টর। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ইরানের শীর্ষস্থানীয় ১২ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ।
নিহত বিজ্ঞানীদের পরিচয়
ইরানের সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘মেহর নিউজ’ নিহত বিজ্ঞানীদের নাম প্রকাশ করেছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন:
-
ড. ফারিদুন হাকিমি – ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের প্রধান
-
ড. মারযিয়ে বাহরামি – রেডিওআইসোটোপ গবেষণার বিশেষজ্ঞ
-
ড. রেজা সালেহী – ফাস্ট ব্রিডার রিঅ্যাক্টর ডিজাইনার
-
ড. আলী জাভান – পারমাণবিক থার্মাল স্ট্যাবিলাইজেশন প্রকল্পে লিড
-
ড. সাইরাস বেহরুজ – হেভি ওয়াটার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর
-
ড. লায়লা খোরশিদ – পারমাণবিক মেডিসিন ডিভিশনের প্রধান
-
ড. হামিদ বাশারাত – সেন্সিটিভ পারমাণবিক রিসার্চ ইউনিট প্রধান
-
ড. তাহমিনা রাস্তগার – আইএইএ অনুবর্তীতা বিষয়ক কর্মকর্তা
-
ড. আরিফ হোসেইনি – পরমাণু নিরাপত্তা প্রকল্প পরিচালক
-
ড. নাসরিন জামিল – নিউট্রন বোম্ব গবেষণা কমিটির সদস্য
-
ড. শেহনাজ মরাদী – ইউরেনিয়াম স্টক সংরক্ষণ প্রকল্প প্রধান
-
ড. কাশান আবতাহী – কোর ডিজাইন রিসার্চ লিড
এই ১২ জন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির "মস্তিষ্ক" বলেই পরিচিত ছিলেন। তাঁদের একসঙ্গে হারানো ইরানের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
তেহরানের প্রতিক্রিয়া
ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ ইব্রাহিম রায়িসি এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন:
"এটি কেবল ইরানের বিরুদ্ধে নয়, বরং বৈশ্বিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর বর্বর আঘাত। আমরা এর জবাব দেব—সময় ও পদ্ধতি আমরা নির্ধারণ করব।"
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল আবারও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। জাতিসংঘে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সরাসরি দায় স্বীকার না করা হলেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গালান্ট একটি প্রতিক্রিয়ায় বলেন:
"যে কোনো রাষ্ট্র, যাদের পরমাণু কর্মসূচি আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাব আমরা।"
অনানুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের নিরাপত্তা সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই হামলা "অত্যন্ত জরুরি ও কৌশলগতভাবে অনুমোদিত" ছিল।
বিশ্ব প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন:
"পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা এক বিপজ্জনক নজির। শান্তিপূর্ণ সংলাপের জায়গায় সহিংসতা এড়িয়ে চলাই বিশ্বনেতাদের দায়িত্ব।"
চীন, রাশিয়া, এবং তুরস্ক এই হামলার নিন্দা জানিয়ে একে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি, তবে প্রতিরক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, "হামলার ফলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।"
পরমাণু কর্মসূচিতে প্রভাব
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ১২ বিজ্ঞানীর মৃত্যু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ৩ থেকে ৫ বছর পেছনে নিয়ে যেতে পারে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে শুরু করে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ডিজাইন পর্যন্ত মূল প্রযুক্তিগত বিভাগগুলোর অগ্রগতিতে বড়সড় বিঘ্ন ঘটবে।
বিগত কয়েক বছরে ইসরায়েল বেশ কয়েকবার ইরানের পরমাণু স্থাপনায় সাইবার হামলা (যেমন "স্টাক্সনেট") চালালেও এই হামলা ছিল সম্পূর্ণ সামরিক ও হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যপ্রসূত।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: এটি কি একমাত্র ঘটনা?
না। এর আগেও ২০১০-২০২০ সাল পর্যন্ত ইরানে মোট ৬ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য করে গাড়ি বিস্ফোরণ বা স্নাইপার হামলার শিকার হন। ইরান বরাবরই এসব ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।
তবে একসঙ্গে ১২ বিজ্ঞানীর মৃত্যু এই প্রথম এবং এটিকে "ইতিহাসের ভয়াবহতম বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ড" হিসেবে আখ্যায়িত করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকদের মতামত
মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. রেহানা মাহবুব বলছেন:
"এই হামলা ইরানকে সাময়িকভাবে দুর্বল করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি আরও র্যাডিকাল প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে।"
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি বিশেষজ্ঞ জন ব্রাউন বলেন:
"ইরান এখন 'শহীদ' বিজ্ঞানীদের নামে নতুন কর্মসূচি চালু করতে পারে, যার মধ্যে দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের লক্ষ্য আরও জোরালোভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।"
ভবিষ্যৎ কি অপেক্ষা করছে?
ইরান ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। নিহত বিজ্ঞানীদের দাফন তেহরানের ‘বেহেশতে জাহরা’ কবরস্থানে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে সম্পন্ন হচ্ছে। বিশাল জনতা সেখানে জড়ো হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে—“শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে না”।
ইরান কূটনৈতিকভাবে এর জবাব দেবে, তবে সামরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার সম্ভাবনাও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সিরিয়া, লেবানন কিংবা ইরাক থেকে ইসরায়েলের কোনো স্থানে রকেট বা ড্রোন হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA।
উপসংহার
"ইসরায়েলি হামলায় ইরানের শীর্ষ ১২ পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু" শুধু একটি সংবাদ নয়—এটি একটি নতুন বাস্তবতার সূচনা। যেখানে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কৌশলগত হত্যা এবং পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগিতা এক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে—ইরান কীভাবে জবাব দেয়। এবং সেই জবাব কেমন প্রভাব ফেলবে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বশান্তির ওপর, তা সময়ই বলে দেবে।
#ইরান #ইসরায়েল #পরমাণু_বিজ্ঞানী #মধ্যপ্রাচ্য #ড্রোন_হামলা #নিউজ #বিশ্লেষণ #জিও_পলিটিকস